মানুষের জীবনের শেষ দিনগুলো:

 

মানুষের জীবনের শেষ দিনগুলো:

বৃদ্ধাশ্রমের এক কোনায় বসে থাকা আব্বাস সাহেব একসময় ছিলেন একজন সুপরিচিত শিক্ষক। জীবনের ৭0টি বছর পার করে তিনি এখন ক্লান্ত। তার শীর্ণ চেহারায় জড়িয়ে থাকা বলিরেখা, সাদা চুল আর নিস্তেজ চোখে জীবনযুদ্ধের সব অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তার জীবনের শেষ দিনগুলোয় তার মনে হয়, এই দীর্ঘ জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল একাকীত্ব।

আবু সাহেব বৃদ্ধাশ্রমে আসেন তিন বছর আগে। তার একমাত্র ছেলে রাজন স্ত্রীসহ প্রবাসে থাকে। সেখানে তারা নতুন জীবনের স্বপ্নে মত্ত। কয়েক বছর আগে, আবু সাহেবের স্ত্রী মারা গেলে রাজন প্রাথমিকভাবে বাবাকে নিজের কাছে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আব্বাস সাহেব কখনো তার শিকড় ছেড়ে যেতে চাননি। আর রাজনের কাছে একসময় স্পষ্ট হয়ে যায়, বাবাকে নিজের জীবনে জায়গা দেওয়া তার ব্যস্ততার জন্য সহজ হবে না। ফলে বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে ওঠে আব্বাস সাহেবের ঠিকানা।

প্রথম দিন

এক সকালে আব্বাস সাহেবের ঘরে এসে বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধায়িকা রুমিনা বললেন, “চাচা, আপনি কি ঠিক আছেন? আজ আপনাকে একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “রুমিনা, আমি ঠিক আছি। তবে বুকের মধ্যে এক ধরনের ভারী অনুভূতি হচ্ছে। যেন সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

রুমিনা অবাক হন। “কেন এমন বলছেন চাচা? আমরা তো আছি আপনার সঙ্গে।”

আ্বিাস সাহেব একটু ম্লান হেসে বললেন, “তুমি আছ, এটাই আমার সান্ত্বনা। তবে মনে হয়, আমার বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে।”

স্মৃতির জানালা

সারাদিন আব্বাস সাহেব স্মৃতির জানালায় উঁকি দেন। স্কুলে ছাত্রদের পড়ানোর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। কেমন করে মেয়েদের পড়াশোনার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন। তাদের জীবনে আলোর পথ দেখাতেন। নিজে শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়েছেন, তাই চেয়েছিলেন অন্যদের জীবনেও তা ছড়িয়ে দিতে।

তার স্ত্রী মমতাজ ছিলেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের একসঙ্গে কাটানো সময়, হাসি-আনন্দ আর সুখ-দুঃখে মিশে থাকা দিনগুলো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু মমতাজ এর মৃত্যুর পর থেকেই যেন তার জীবন থেকে রং সরে যেতে শুরু করে।

দ্বিতীয় দিন

পরের দিন সকালে আব্বাস সাহেব জেগে ওঠেন তীব্র বুকে ব্যথা নিয়ে। বৃদ্ধাশ্রমের ডাক্তার এসে বলেন, “চাচা, আপনাকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে।”

আব্বাস সাহেব মাথা নাড়লেন। “না, আমার আর কোনো হাসপাতালে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।”

বৃদ্ধাশ্রমের অন্য বাসিন্দারা তার পাশে এসে বসে। কেউ বলেন, “চাচা, আপনি আমাদের সবার সাহস। আপনি যদি হাল ছেড়ে দেন, তবে আমরা কী করব?”

তিনি বলেন, “আমি তো তোমাদের সবার জন্যই বেঁচে আছি। তবে মনে হয়, আমার সময় শেষ।”

তৃতীয় দিন: সন্তানদের অভাব

বিকেলে রাজন ফোন করে। “বাবা, কেমন আছেন? আমি কয়েক মাস পর দেশে আসব।”

আব্বাস সাহেব বলেন, “আমি ভালো আছি, বাবা। তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। আমার জন্য চিন্তা করো না।”

রাজন বুঝতে পারে না, বাবা কেন এত নিরুত্তাপ। বৃদ্ধাশ্রমের জীবন যে কতটা একাকী আর কষ্টকর, সেটা রাজন ধারণার বাইরে। কিন্তু আব্বাস সাহেব একথা বুঝিয়ে বলতে চান না।

শেষের দিন

তৃতীয় রাতের শেষে আব্বাস সাহেব হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তার মনে হয়, কেউ যেন তাকে ডাকছে। বাইরে গিয়ে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত প্রশান্তি।

তিনি মনে মনে বলেন, “জীবনটা তো এমনই। আমরা আসি, কিছু স্মৃতি রেখে যাই, তারপর চলে যাই। আমার কাজ শেষ। এখন সময় হয়েছে মুক্তি পাওয়ার।”

ভোরের আলো ফোটার আগেই বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধায়িকা এসে দেখেন, আব্বাস সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন চিরনিদ্রায়। তার মুখে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তির হাসি।

শেষকথা

মানুষের জীবনের শেষ দিনগুলো একেকজনের জন্য একেক রকম। কেউ শেষ দিনগুলো কাটায় পরিবারের ভালোবাসায়, কেউ কাটায় একাকীত্বে। কিন্তু সবশেষে, মৃত্যুর সামনে সবাই সমান। আবু সাহেব তার শেষ দিনগুলোতেও নিজের অতীতের স্মৃতিতে বেঁচে ছিলেন। তার গল্প আমাদের শিখিয়ে যায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্যায়ন করতে, ভালোবাসা দিতে আর পেতে। কারণ একদিন, আমরা সবাইকে চলে যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Smartwatchs